জনমানুষের ভাষা: কীভাবে দান্তে ইতালীয় পরিচয় গড়ে তুললেন

ইতালির জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় আজ যে দৃঢ় রূপে দাঁড়িয়ে আছে, তার মূলে একটি নাম অনিবার্য—দান্তে আলিগিয়েরি। তিনি শুধু একজন কবি নন; তিনি ছিলেন ভাষা-সংস্কারের অগ্রদূত, যিনি “জনমানুষের ভাষা”—ভলগার ইতালিয়ান—কে সাহিত্যিক মর্যাদা দিয়ে ইতালিকে একটি একক জাতিসত্তার দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সৃষ্ট ডিভাইন কমেডি শুধু একটি মহাকাব্য নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যা ছড়িয়ে পড়ে ভাষা, রাজনীতি, জাতীয় আত্মপরিচয় এবং সাহিত্যিক শৈলীতে।

মধ্যযুগের ভাষা-বৈচিত্র্য: বিভক্ত ইতালির চিত্র

দান্তের যুগে ইতালি ছিল একক রাষ্ট্র নয়—নগর-রাষ্ট্র, রাজ্য ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত।
রোমাগ্নো, টাস্কান, নেপোলিটান, সিসিলিয়ান, ভেনেশিয়ান—প্রতিটি অঞ্চলের ভাষা ছিল আলাদা।
শিক্ষিত মহলে ল্যাটিনের ব্যবহার এই বিচ্ছিন্ন ভাষাগুলোর ওপর একটি ছায়া বিস্তার করেছিল, ফলে সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা সাংস্কৃতিক গুরুত্ব পেত না।
এই ভাষাবিভক্তি রাজনৈতিক বিভক্তির প্রতিফলনও ছিল; ফলে একটি একীভূত “ইতালিয়ান পরিচয়” তখনো গড়ে ওঠেনি।

দান্তের সাহসী সিদ্ধান্ত: জনমানুষের ভাষায় মহাকাব্য

দান্তে যখন ডিভাইন কমেডি লেখার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি ল্যাটিনকে এড়িয়ে যান।
এটি শুধু একটি ভাষা-সংক্রান্ত পছন্দ ছিল না; এটি ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান।
তিনি বললেন—মানুষের সাধারণ ভাষাই সাহিত্য সৃষ্টির উপযুক্ততম ভূমি।
এই সিদ্ধান্ত ইতালীয় জনগণের ভাষাকে সম্মান দেয়, মর্যাদা দেয়, এবং প্রথমবারের মতো শিল্পের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

“ভলগার”কে “ঐশ্বরিক” করা

দান্তে তাঁর কর্মে দেখান, কথ্য ভাষা কখনো নিম্নমানের নয়।
তিনি ইতালীয় কথ্য ভাষাকে—

ছন্দের জ্যোতি,

সাহিত্যিক গভীরতা,

দার্শনিক শ্রেষ্ঠত্ব,

ধর্মীয় প্রতীক,

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ

—সব মিলিয়ে এক মহান শিল্পরূপে রূপান্তর করেন।

এর ফলে মানুষ বুঝতে শুরু করে—তাদের নিজের ভাষাই জাতীয় গৌরবের উৎস।

ইতালীয় ভাষার মানদণ্ড ও টাস্কান উপভাষার উত্থান

দান্তে যে ভাষায় লিখেছেন—টাস্কান উপভাষা—তা ধীরে ধীরে ইতালীয় মানভাষার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
যে অঞ্চলে ফ্লোরেন্স অবস্থিত, সেই টাস্কানি পরে ইতালির সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠায় দান্তের ভাষাচয়ন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে।
তাঁর লেখনী, ব্যাকরণ, শব্দচয়ন, ছন্দ—সবই হয়ে ওঠে একটি “মডেল ভাষা”, যা পরবর্তী সাহিত্যিকরা অনুসরণ করতে থাকেন।

জাতীয় আত্মপরিচয়ের নির্মাণ

জাতীয় পরিচয় কোন খালি মাটিতে জন্মায় না; এটি ভাষা, গল্প, স্মৃতি ও সংস্কৃতির মধ্যে গড়ে ওঠে।
দান্তে তিনটি বড় কাজ করেন—

একটি সাধারণ ভাষাকে একীভূত করেন, যা বিভিন্ন অঞ্চল বুঝতে এবং গ্রহণ করতে পারে।

মহান সাংস্কৃতিক গ্রন্থ সৃষ্টি করেন, যা সমগ্র ইতালির মানুষের মধ্যে গর্বের উৎস হয়ে ওঠে।

একটি যৌথ কল্পনা জগৎ নির্মাণ করেন—স্বর্গ, নরক, পুরগাতোরি—যা জাতির সমষ্টিগত মানসিকতার অংশ হয়ে যায়।

দান্তে প্রথম এমন এক সাহিত্যিক যিনি ইতালীয়দের বলেছিলেন, “আমরা একই ভাষার মানুষ, আমরা একই কাহিনির অংশ।”

ল্যাটিন বনাম ইতালিয়ান: দান্তের সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ

মধ্যযুগের চার্চ ও শিক্ষা ব্যবস্থা ল্যাটিনকে “উচ্চ ভাষা” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল।
দান্তে এই শ্রেণী-ভিত্তিক ভাষাচর্চাকে চ্যালেঞ্জ করেন।
তিনি দেখান—মানবের অভিজ্ঞতা, আবেগ, বেদনা, প্রেম, নৈতিকতা—এসব বিষয় সাধারণ মানুষই সবচেয়ে ভালোভাবে অনুভব করে, আর সেই অনুভূতির ভাষাই সবচেয়ে প্রকৃত ভাষা।

এটি ছিল এক ধরনের ভাষাগত গণতন্ত্র।

পরবর্তী সাহিত্যিকরা দান্তেকে অনুসরণ করেন

পেত্রার্ক ও বোক্কাচ্চিও—ইতালির দুই মহান হিউম্যানিস্ট—দান্তের পথ অনুসরণ করেন।
তাঁরা টাস্কান ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করেন।
১৫ শতকের পর ইতালির সাহিত্য, প্রশাসন, দর্শন, রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই দান্তের ভাষা ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

অবশেষে ১৯ শতকে ইতালি যখন রাজনৈতিকভাবে একীভূত হয়, তখন দান্তের ভাষাই জাতীয় ভাষা হিসেবে মান্যতা পায়।

দান্তে: “ইতালির পিতা” হিসেবে স্বীকৃত

ইতালীয়রা তাঁকে বলেন “Il Padre della Lingua Italiana”—ইতালীয় ভাষার পিতা।
তাঁর জন্মদিন জাতীয় দিনে পরিণত হয়েছে, স্কুলের পাঠ্যক্রমে তাঁর লেখা বাধ্যতামূলক, আর দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু তাঁর রচিত ভাষা।

দান্তে শুধু একটি ভাষা তৈরি করেননি—তিনি একটি জাতি তৈরি করেছিলেন।

দান্তে আলিগিয়েরির ভাষা-সংস্কার ইতালির আত্মপরিচয়ের মূল ভিত্তি।
তিনি সাধারণ ভাষাকে সাহিত্যিক অস্তিত্ব দেন, মানুষকে নিজের ভাষায় নিজের গল্প শোনার সাহস দেন, এবং একীভূত জাতীয় পরিচয়ের বীজ বপন করেন।

ইতালির সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং আধুনিকতার প্রতিটি স্তম্ভে দান্তের এই সিদ্ধান্ত—“জনমানুষের ভাষাই জাতির ভাষা”—আজও অটল সত্য হয়ে বেঁচে আছে।

Leave a Comment